অদ্ভুত শহর - ১

ছবিঃ অদ্ভুত শহর - ১


২০১৩ থেকে ২০১৭ এই সময়কালে নিরব, জন-মানবহীন ঢাকা শহর দেখার অভ্যেস ছিল। তাই প্রতি রাতে ১ টা বা ২ টার সময় বের হতাম নিয়ম মাফিক। সাথে আরো ২/৩ জন থাকত। ধানমন্ডির রাস্তায় তখনও দ্রুত ছুটে চলত প্রাইভেটকার, সি এন জি। রিক্সাওয়ালারা রাস্তার পাশে, কখনও ফুটপাতের উপর রিক্সা দাড় করে রেখে ঘুমিয়ে থাকত আট-সাটো করে রিক্সার সিটের উপর । দেখতে দেখতে ৭ টা বছর পেরিয়ে এখন ২০২০ । কিন্তু পরিবর্তনটা ভিন্ন রকমের।

হটাৎ এক অজানা সঙ্কা, মৃত্যুভয় মানুষকে ভীত করে ঘরে আটকিয়ে ফেলেছে। ফলাফল – ঢাকা এখন সন্ধ্যা ৭ টায় ভুতুরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। রাস্তার ল্যাম্পোস্ট গুলিও ঠিক আগের মত আলো দেয় না । অনিরাপদ যায়গাগুলিতে আর পুলিশের টহল ভ্যান দাড়িয়ে থাকে না। প্রয়োজন হয় না মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার। তবে সেদিনের আর আজকের দিনের পার্থক্য ভাবিয়ে তোলার মত । এখন রাস্তার মোড়ে একই সাথে ৩/৪ টি আম্বুলেন্স দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় । কিসের যেন একটা জরুরী সংকেতের অপেক্ষায় থাকে আম্বুলেন্সগুলি ।

একটু বেশিই অবাক হতে হয় রাস্তার কুকুর গুলির দিকে তাকালে । তারা আগেরমত আর ঘেউ ঘেউ করেনা। মানুষ দেখলে আর কাছে এসে খাবারের আকুতি জানায় না। তারা আর মানুষের আদর – নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনা। খুব সম্ভবত তারা বুঝে গেছে – এই মানুষ জাতি আর বেশিদিন তাদের আদর কিংবা খাবার দিতে সক্ষম নয়।

যে স্থানগুলিতে প্রগতিশীল নারীবাদী এবং তাদের কতিপয় (কথিত) পজিটিভ মাইন্ডেড বয়ফ্রেন্ডরা এসে রাত ১০/১২টা অব্দি আড্ডা দিত এবং নিজেদের শিক্ষার আলো গরীব, নিম্নশ্রেনীর মানুষগুলিকে অনুধাবন করানোতে ব্যস্ত ছিল তাদেরও আর দেখা যায় না। স্থানগুলি সম্ভবত এখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আগেরমত আর শুক্রবার জুম’আ এর নামাজ শেষ হতে না হতেই – নর্তকীর বেশে কোন ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রীকে স্পেশাল ক্লাসের জন্য ধানমন্ডী লেক বা মানিকমিয়া এভিনিউ এর মত ফুর্তিময় স্থানে যেতে দেখা যায় না। পহেলা বৈশাখে আর মঙ্গল কাকা মঙ্গলের বার্তা নিয়ে লুটপুটি খায় না। এখন আর চারুকলার কারুকলায় নারীমূখ অঙ্কিত হয় না। ঐদিকে খান সাহেবের উচ্ছিষ্ঠরাও এখন আর বোন ভাগ্নির সংসারে ঝামেলা লাগিয়ে ২ পয়সা ফায়দা করতে পারে না।

চটপটি, ফুসকার টং দোকানগুলিতে অনেক ধুলো জমে আছে । পরিষ্কার করার কেউ নেই। রোজ সন্ধায় ফুটপাতের টং দোকানগুলিতে অমুক ভাই, তমুক ভাই এর দল বল এসে আর বলে না আজকের কলেকশন কমিশন দে। রাস্তায় আর দামী দামী পাজেরো, প্রাডো, অডি, মারসিডিস, বিএমডব্লিউ দেখা যায় না। বাসের সুপারভাইজার/কন্ট্রাক্টর কে শুনতে হয় না – “আমাকে চিনছ (যেটা হত বড়োজোর ৫/১৫ টাকার দ্বন্দ)” । মোবাইল কোম্পানিগুলিও আর বলে না – কাছে থাকুন, এগিয়ে চলুন ধরনের ফাকা বুলি। রাস্তায় আর উবার, পাঠাও চালকদের মুখে “ভাই কোথায় যাবেন” প্রশ্নটি আর শোনা যায় না।

ফুটপাতে আর শোনা যায় না - “দেইখা লন বাইছা লন” স্লোগান। শহরের বড় বড় হসপিটাল / ক্লিনিক যেগুলি আগে রোগী পেলেই খুশিতে গদ্গদ করে উঠত – তারাও এখন রোগী দেখলে ভয় পায়। ফার্স্ট ফুডের দোকানে এখন আর ভিড় হয় না – ভিড় হয়, মাস্কের, চাল, ডালের দোকানে। এখন যে কোন বাড়ির সামনে গাড়ী পার্ক করে রাখা যায় । কেউ বলেনা এখানে গাড়ি রাখা নিষেধ। চা এর টং দোকানে এখন আর কোন উপরী ইনকাম ওয়ালাদের দেখা যায় না। আর শুনতে হয়না – “আমি অমুক নেতার তমুক অথবা আমি অমুক লিডারের ফিতা ধরে ঘুরে বেড়াই” ধরনের বুলি।  সত্যিই এ এক অন্য ধরনের পরিবর্তন। যে পরিবর্তন মানব জাতি কোন কালেই কল্পনা করতে পারে নাই।

হ্যাঁ, এতকিছুর পরেও – একটা বিষয় চোখে পড়ে অবাক লাগল- যে মানুষগুলিকে আমরা মুল্যায়ন করতে অসস্তিতে ভুগতাম সেই মানুষগুলি। মসজিদের ইমাম সাহেব, মোয়াজ্জিন এবং পুলিশ । মোয়াজ্জিন সাহেব মসজিদের সিঁড়িতে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আসে আসে পাশের রাস্তার দিকে। তারপাশে ইমাম সাহেবকেও দেখলাম। চোখে ছলছল করছে পানি। হয়ত লজ্বায় জোরে শব্দ করে কাদতে পারছে না। কিন্তু কেন? 
তাদেরকে দাণ- দক্ষিনা দেওয়ার মানুষ নাই বলে?
তাদের আখেরাতের কথা শোনার মানুষ নাই বলে?
নাকি অন্য কোন কারণ?

সে প্রশ্নের উত্তর ও শুনে এসেছি। উনারা দুইজন যা বলেছেন – তা খুব বেশিই অবাক করেছে আমাকে। মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে জুম’আ এর খুদবা। আমাদের তওবাকে হয়ত কবুল করছে না-আল্লাহ তায়ালা। আরো ভাল করে তওবা করা উচিৎ, যেন উনি আমাদের মাফ করে দেন। শুক্রবারে জামাত হয় না। ৫ ওয়াক্ত জামাতেও আগেরমত অনেক মানুষের সমাগম হয় না। আর কাউকে বলতে হয় না – নামাজের সময় মোবাইল ফোন বন্ধ রাখুন কিংবা দাড়িয়ে কাতার সোজা করুন। এতটুকু বলে নিশ্চুপ উপরে তাকিয়ে রইলেন। আমিও আর বেশি কিছু জিজ্ঞাস করার মত সাহস পেলাম না একটু দাড়িয়ে মাথা নিচু করে ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে এলাম। এই দুইজন মানুষ একবারও বললনা, যে তাদের কে দান করুন, টাকা দিন, চাল-ডাল দিন। তাদের পরিবার অভাবে বা অনাহারে আছেন। কিন্তু এই দুইজন মানুষ ছাড়া যাদের সাথেই কথা হয়েছে তারা সবাই একই কথা- লকডাউনে না খেয়ে মরে যেতে হবে।

মন্তব্যসমূহ